যৌবনের পরন্ত বেলায় উপনিতা । তবুও দেখতে অপরুপা । উন্নত ব্যক্তিত্ব আর আকর্ষনীয় দেহ-কাঠামোর জন্য শীলাদেবী এক অনন্য মোহনীয় চরিত্রের অধিকারী মহিলা । আগে যারা তাকে কলঙ্কিনী শীলা বলে জানতো , এখন ধীরে ধীরে তারা তাকে দেবী ভাবতে শুরু করে দিয়েছে । এটা এমনি এমনিই হয় নাই । একটা অসহ্য যন্ত্রণা ও দুঃখবোধ তাকে ঐশ্বরিক পথ ধরে দেবীর আসনে বসিয়ে দিয়েছে । তার কাছে ধরনা দিতে এখন অনেকেই বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে । বিশেষ করে তরুনরা তার খুবই ভক্ত ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শত্রুসেনারা একদিন শীলাদের গ্রাম ঘিরে ফেলে । এর আগেও তারা আশ-পাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল । অবাধে গুলি চালিয়েছিল । এরুপ অবস্থায় ভয় আর আতঙ্কে গ্রামের মানুষ দিশেহারা হয়ে পরে । নিজেদেরকে রক্ষার জন্য তারা খুব একটা সাহসী হতে পারলো না । লড়াইয়ের ময়দানে বুদ্ধিভিত্তিক শূন্যতা প্রকট হয়ে উঠলো ।
শীলা তখন সবেমাত্র নবযৌবনা । বন্ধু-প্রিয়-আত্মীয় সহ গ্রামবাসীকে বাঁচানোর জন্য সে নিজের জীবনকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে চাইলো । ধীরে ধীরে দৃঢ় পদক্ষেপে শত্রুসেনাদের সেনাপতির কাছে চলে এলো । নিজেকে মেলে ধরলো প্রষ্ফুটিত পুষ্পের মত । শত্রুসেনাদের মনোরঞ্জনের খায়েশ মিটিয়ে গ্রামবাসীকে বাঁচাবার এ এক ভয়ানক কৌশল । একটু এদিক-ওদিক হলেই মহা-সর্বনাশ । সৌন্যরা শীলাকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে গেল । গ্রামবাসী রক্ষা পেল । কিছুদিন পর শীলা ফিরে এলো সব হারিয়ে ।
এরপর যুদ্ধশেষে দেশ স্বাধীন হলো । গ্রামের মানুষজন কেমন জানি বদলে গেলো । শীলার বুদ্ধিমত্তা আর ত্যাগের মহিমা তারা বুঝতেই পারলো না । তারা তাকে অপবাদের পর অপবাদ দিয়ে মারাত্মক মনোকষ্টে ফেলে দিলো । হাসি-খুশি ভাব নিয়ে শত্রুসেনাদের সাথে লীলা -----, ছিঃ ! ছিঃ ! এ মেয়ে গ্রামের মানুষের মুখে চুন-কালি দিয়ে দিলো । এরকম হাজারো অপবাদ দিয়ে দিয়ে তারা তাকে কলঙ্কিনী বলতে লাগলো । তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, ভর্ৎসনা আর সমালোচনার মাত্রা বাড়িয়ে দিলো । এরুপ জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে, সে নিজে নিজেই গ্রাম ছাড়া হয়ে গেলো ।
গ্রামের দক্ষিন পাশে বড় রাস্তার মোড়ে একটা প্রকান্ড বটগাছ । বিপরীত দিক থেকে একটা নদী বটগাছ বরাবর এসে বাঁক নিয়ে ভাটির দিকে বয়ে চলে গেছে । নদীর ওপারে ধুঁ ধুঁ বালুচরে কয়েকটি জেলে পরিবারের বাস । এখানেই অতি কষ্ঠে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে শীলা ।
তটিনীর বয়ে চলা আর প্রকৃতির অপরুপ রুপ-বৈচিত্র দেখে দেখে শীলার হৃদয়ে স্রষ্টাকে মিনতি জানাবার বাসনা তীব্র হয়ে উঠে । বটগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্য উদয়ের দৃশ্য প্রতিদিনই তার মনে স্বাধীনতার সুফল লাভের নোতুন নোতুন অর্থ সৃষ্টি করে চলে ।
বর্ষা মওসুমে এই জেলে পল্লীতে বেদেরা আসে তাদের নৌকার বহর নিয়ে । কর্মে চঞ্চল, ত্যাগে বেহিসাবী, প্রেমে সীমাহীন অথচ শিশুর মত সরল মন -------, এই লোকগুলোর সাথে মেলামেশা করে " জীবন ও জগত " সম্পর্কে শীলার ধারনা দিনদিন বদলে যেতে থাকে । সাথে সাথে স্রষ্টা সম্পর্কিত তার ধারনাগুলো যখন ক্লান্ত-অবশ হয়ে তার কাছেই ফিরে আসে -----, তখন তার মধ্যে ঘটতে থাকে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন । এক বিপ্লবী চেতনায় সে উজ্জিবীত হতে থাকে । জীবনের জয়গানে সে বে-পরোয়া হয়ে উঠে । মুক্তির মন্ত্র মূহর্মূহু নবরুপ লাভ করে । লোকমুখের কলঙ্কের বুলিকে পিছনে ফেলে----- জ্ঞান-ধ্যান, সত্য,সুন্দর ও পবিত্রতার মিশেলে শীলা এখন অনন্য মহীমায় উদ্ভাসীত এক মনোরমা রমনী । স্রষ্টার সন্ধান আর জনসেবা তাকে সম্মানের উচ্চস্তরে পৌঁছে দিয়েছে । তার গ্রামের কিছু লোক ছাড়া দূর-দুরান্ত পর্যন্ত সে একজন সম্মানীতা মহিলা হিসাবে পরিচিত ।
একেক জলাশয়ের চরিত্র একেক রকম । এর মর্ম উপলদ্ধি করা খুবই কঠিন । নদীর বয়ে চলা আর জোঁয়াড়-ভাটার প্রভাবে এর পরিবর্তনের ধারা বেশ রহস্যময় । নদী তীরের মানুষ কিছুটা জানতে-বুঝতে পারলেও এর বেশীর ভাগই থেকে যায় অজানা ।
শুক্লপক্ষের ভরা দুপুর । নদীর পানি ফুলে উঠেছে । সাঁতারে অপটু গ্রাম্য মোড়লের ছেলে নদীতে জলকেলী করছিল । হঠাৎ স্রোতের তোড়ে সে ভেসে যেতে থাকে । একবার ডোবে , একবার ভাসে------, এভাবে নাকানী-চোঁবানী খেতে খেতে অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা । শতশত লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছে । চেঁচামেচি আর হা-হুতাশ করছে । ভেসে গেলো, ভেসে গেলো । বাঁচাও , বাঁচাও । কিন্তু কে বাঁচাবে ?
দুর থেকে শীলা দৌড়ে এলো । সবাইকে অবাক করে দিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পরলো । প্রথম চেষ্টায় পারলো না । এক বুক পানিতে দাঁড়িয়ে এক পলকের বুদ্ধিতে ----, পরনের ভেজা শাড়ী খুলে ফেললো । এক প্রান্ত ছেলেটির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে অপর প্রান্ত হাতে পেঁচিয়ে টেনেটেনে কোনোরকমে ছেলেটিকে কিণারে নিয়ে এলো । সবাই ধরাধরি করে বটগাছটার নিচে নিয়ে গেল । জলস্নাত, আধা অনাবৃত, ধবধবে সাদা শীলার দেহখানি সূর্য্যের কিরণে ঝলমল করে মানবতার যে জয়গান গেয়েছিল-----, এর মর্ম সবাই একরকম ভাবে বুঝতে চায়নি ।
চেতনা ফিরে পেয়ে ছেলেটি বুঝতে পারল ----, তার দেহখানা আছে মাটিতে আর মাথা শীলার কোলে । চোখাচোখি হতেই তার কাছে অদ্ভুত লাগে সব । তবু যেন মনে হয় সবকিছু অপরুপ । ক্ষণিকের তরে খুঁজে পেয়েছিল শত জনমের সুখ ।
চিটার, বাটপার আর গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তারের অভাব কোনোকালে কোথায়ও ছিল না । তাদের লোভাতুর বাসনা এখানেও ডানা ঝাঁপটাতে লাগলো । চিকিৎসার নামে টাকা কামাইয়ের ধাঁন্ধা নিয়ে বেশ কয়েকজন এসে হাজির হলো । নদীতে ডোবা রোগীর বিভিন্ন রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলে তারা আতঙ্ক ছড়াতে লাগলো । পানি খেয়ে রোগীর পেট ফুলে গেছে । একে এক্ষুনি ওয়াশ করতে হবে । হাসপাতালে নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থা তারা করে দিবে । এরকম আরো কতশত কথা ! তাদের মধুময় সব কথার আঁড়ালে লোভের লকলকে মুচকী হাসির রহস্য বুঝা ভার ।
ওয়াশ করার বাহানায় রোগীর পেটে পাইপ ঢুকিয়ে অতিমাত্রায় নাড়াচাড়া আর চাপ দিয়ে এমন অবস্থা করা হবে যাতে রক্তক্ষরন হয় । আর পাইপের মাথা দিয়ে মুখে রক্ত চলে আসে । এরপর শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে । তারপর উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে পাঠিয়ে দিয়ে অপারেশন করতে বাধ্য করা হবে । এমনতরো সব পরিকল্পনা শেষ । কোনকোন জায়গায় কে কত কমিশন পাবে ---, সে হিসাবও হয়ে গেছে । এখন শুধু রোগীকে এ্ম্বুলেন্সে তুলতে পারলেই হয় ।
কিন্তু বিধি বাম । শীলা বাধ সাধে । সে বলে কিছুই হয়নি । ছেলেটিকে মোড়ল বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয় । শীলাও সাথে যায় । একদিন কলঙ্কিনী বলে যারা শীলাকে গ্রাম ছাড়া হতে বাধ্য করেছিল । আজ আর তারা তাকে সেভাবে কলঙ্কিনী বলার সাহস দেখাতে পারলো না । পেটে চাপ দিয়ে বমির চেষ্টা করার জন্য শীলা ছেলেটিকে বললো । এতে কিছুটা কাজ হলো । এরপর সারাদেহে ঘন করে লবন মাখিয়ে দেয়া হলো । ছেলেটি ধীরে ধীরে সুস্থ্য ও স্বাভাবিক হয়ে উঠলো । ছেলেটির নাম ছিলো ------ 'রকি' ।
এরপর থেকে রকি প্রায়ই শীলার কুটিরে যাওয়া-আসা করতে থাকে । সে ঋন শোধ করতে চায় । শীলার ইচ্ছা-আশা-আকাঙ্খা পুরনের জন্য সে ক্রীতদাসের মত ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে । প্রভুভক্ত কুকুরের মত সময়ে-অসময়ে ছুটে আসে । শীলার মনে পরে যায়---, একদিন গ্রামবাসীকে বাঁচাবার চেষ্টার প্রতিদানে সে কলঙ্কিনী খেতাব পেয়েছিল । আর আজ রকিকে বাঁচানোর প্রতিদানে দেবী উপাধী পেতে চলেছে ।
গ্রামের লোকেরা নানা ধরনের কথা বলাবলি করছে । বিশেষ করে মোড়ল বাড়ীতে কানাঘুঁষা চলছে । আপনজনদের অনেকেই রকিকে বলে ফেলেছে---, " কেন যাস ঐ নষ্ট মহিলার কাছে " ? এর উত্তরে রকির সাদাসিধা কথা----, " অত কিছু বুঝি না । আমার কাছে এখন সে দেবীর মত " ।
পূর্ণিমার ভরা চাঁদ , জোস্নার আলো , নদী-তীরের স্নীগ্ধতা-------, সব মিলিয়ে এক মধুময় মায়াবী পরিবেশ । অনেক গল্প আর ভাবের আদান-প্রদান শেষে কথায় কথায় রকি বলে ফেলে ----,
" জানিনা তুমি কত রহস্যময়ী---,
জানিনা তুমি কোন জাতের দেবী " !!
দেবী , দেবী , দেবী----, এই শব্দটা শুনতে শুনতে শীলার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে । সে ঠোঁটের কোনে হাসি লুকিয়ে নিয়ে রকিকে বলে--, " এই দেবী রহস্য বুঝতে হলে তোমাকে দেবতা হওয়ার চেষ্টা করতে হবে " ।
" যশে কাজ নাই , নাই চাও খ্যাতি , চেয়ো নাকো ধনমান,
মোর স্তরের যোগ্য করিয়া শিখাইয়া দিমু তোরে গান " ।
রকি বুঝে ফেলে ---, এই দেবীর সাথে পাল্রা দিয়ে চলতে গেলে দৈব জ্ঞান লাভ করা ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নাই ।
দেবতার আসনে বসি, যদি বাঁজানো যায় বাঁশি ,
সেই বাঁশির সুরে হয়তোবা শিহরিত হতে পারে ---,এই দেবী ।
জ্ঞানে-গুনে,শক্তি-সৌন্দর্যে রকির দেবতাসম হওয়ার বাসনা দেখে শীলা শিহরিত হয়ে উঠে । তার এই আগ্রহ শীলাদেবীকে গোপন আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলে । সাধুবেশী শয়তানদের মোকাবেলায় তিলতিল করে ধারন করা দেবীত্ব রক্ষার প্রয়োজনে সে রকিকে শুধু একটা ছবক দেয় । আর সেটা হলো-----,
" যশো খ্যাতির ঠুনকো এ কাঁচ ভেঙ্গে করো চাখ-নাচুর " ।।
১৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৬২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪